Short Story Karuna Acherjee
জিতু বলল,আজ আমার খুব মন খারাপ। কারণ গত বছর এমন দিনে আমার বাবা ছিল। ঈদের ১০/১৫দিন আগের থেকে মার্কেটে কেনাকাটা শুরু করে দিতাম। আমাদের কেনা কাটার ফাঁকে ফাঁকে গরূব -দুঃখী আত্নীয় স্বজনদের জন্যও কেনাকাটা করতাম। আমি কখনো ভাবিনি এই বছর অন্যের কাছ থেকে হাত পেতে সাহায্য নিয়ে আমাদের ঈদ উৎযাপন করতে হবে।
বাবার এক বন্ধু যাকাত দিচ্ছে। সকালে মা বলল, জিতু –যা আমাদের অবস্থার কথা তো তোর চাচ্চু জানে। যা দেবে হাসি মুখে নিয়ে আসবি। মা’র কথা মত এক পা সামনে দুই পা পিছনে রেখে সকাল সাড়ে সাতটায় গিয়ে লাইনে দাঁড়ালাম সেখানে দাতা সাচ্চুকে দেখা যাচ্ছিল না। শুধু মাথা আর মাথা লোকে লোকারোণ্য। আত্নীয় স্বজনের চেয়ে রাস্তার ফকিরে সয়লাব হয়ে আছে গেইটের বাহিরে। সবাই বলাবলি করতে লাগল দাবীর মনির সাহেব আজ কি কি দেবে বুঝতে পারছি না। এত কষ্ট করে এলাম এই রোদে কিছুক্ষণ পর হলে তো মাথার ছাতি পেটে যাবে। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের কথাগুলো শুনছিলাম।
Short Story Karuna Acherjee
কয়েক জন লোক লাঠি হাতে নিয়ে ছোট ছোট করে ঠেলা দিচ্ছে আর বলছে লাইনে না দাঁড়ালে কেউ যাকাত পাবে না। প্রায় বেলা ১০টা মনির চাচ্চু এলেন কিছু কাপড় আর লুঙ্গি নিয়ে। তার পর দাড়োয়ান এক একজন করে গেইটের ভিতর ঢুকাচ্ছে আর হাতে একটা কাপড় বা লুঙ্গি দিয়ে বের করে দিচ্ছে। কত যোয়ান বুড়া এসেছে হাতে অনেকের বাচ্চা অথবা হাতে লাঠি আছে। আমি পিচ্ছি একটা ছেলে সবাই আমাকে পাশ কেটে কেটে লাইনে আগে আগে জায়গা করে নিচ্ছে। তাদের ধাক্কাধাক্কিতে আমি বারে বারে পিছনে পড়ে যাচ্ছি।
সারা দিন এক পায়ে দাঁড়িয়ে থেকে ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় মুখে রা’টি পযর্ন্ত করতে পাচ্ছিলাম না। সন্ধ্যা প্রায় সাতটা। আরো দীর্ঘ লাইন বাইরে। এমন সময় দাঁড়োয়ান এসে ঝপাৎ করে গেইট টা বেঁধে দিতে দিতে বলল,যাও আজ আর দেওয়া হবে না। তখন মানুষের ভিড় ঠেলে ঠেলে জীবন বাজি রেখে কোন মতে রাস্তায় পা রাখলাম। তখন মাথাটা ঝিম ঝিম করছিল তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছিল।
হায় আল্লাহ! মা আমার দিকে চেয়ে আছে, কিছু না কিছুতো হাতে নিয়ে ফিরবো সেই আশায়। সারা দিন আমি যে কি যুদ্ধ করেছি সামান্য একটা শাড়ি বা লুঙ্গির জন্য মা হয়ত আমার কথা বিশ্বাসই করবে না। কারণ মা তো কখনো যাকাত দেওয়ার দৃশ্য দেখেনি। আর আমরা এই মাত্র প্রথম যাকাত নিতে এলাম। গরীবের ক্ষুধার জ্বালা এই বার আমিও বুঝতে পারলাম। ছোট বেলা থেকে বাবার সাথে মানুষকে যাকাত ফিতরা দিয়েছি। কারো কাছ থেকে কিছু নিতে অভস্ত্য নয় অবস্থ্য নয়। তাই আজ লজ্জা ও সংকোচে কেমন যেন কুকড়ে গেছিলাম। বাবার অকাল মৃত্যতে আজ চোখে মুখে শস্যে ফুল দেখতেছি। সোনার সংসার হঠাৎ করে সাগরে নিমর্জ্জিত হয়ে গেল। মাও একরকম বাধ্য হয়ে আমাকে এই মৃত্যু ঝুকিতে পাঠিয়ে ছিল। নয়তো যে মা সারা জীবন ঘরের ছোঁকাঠ পার হয়নি সে আজ পথের ভিক্ষুক হতে চলেছে। গেল বছর ঈদের পর পর বাবা যদি জমি জিরাত সব কিছু বিক্রি করে বিদেশ না যেত তাহলে আমাদেরকে এই ভাবে পথে নামতে হত না। আর বাবা বিদেশ যাওয়া নয় মাসের মাথায় লাশ হয়ে বাড়িতে ফিরে এলো। দেশে যেমন প্রতিনিয়ত রোড এস্টিডেন্টে মানুষ মারা যায় তেমনি প্রাণে বাঁচতে ও আমাদের আরো সুখি করতে বাবা বিদেশে গিয়েছিল।
Short Story Karuna Acherjee
সুখ কপালে সইলো না বলে আজ আমাদের এই দুর্দশায় পরতে হলো। আর সুসময়ের বন্ধু বান্ধবরা সব আজ আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।কেউ আর ঈদের মার্কেটে যেতে আমাকে ডাকে না।
মা আলো জ্বালিয়ে দরজায় বসে আছে। ছোট্ট বোন রীমা ও মার সাথে বসে বসে ঝিমুছিল। আমাকে আসতে দেখে বোন লাফ দিয়ে উঠে বলল, দাদা দাদা কি এনেছিস আগে আমায় দেখা। আমি তখন কি দেব তার হাতে? লজ্জায় ঘৃণায় আমারো মুখ দেখাতে ইচ্ছে করছিল না। মাকে আমি কি বলব, বুঝতে পারছি না। আমার মত অনেকে আজ যাকাত না পেয়ে খালু হাতে ফিরে এসেছে।
যাকাতের উপর নির্ভর করে যাদের ঈদ করতে হয়, তাদেরকে যে কি কষ্ট করতে হয় তা আগে কখনো বুঝিনি। এবার হাড়ে হাড়ে টের পেলাম গরীবের কাতারে যে কখনো আসেনি সে বুঝবে না গরীবের ব্যথা। এত কষ্ট নিয়ে যারা রোজা রাখে আর রোজা মুখে নিয়ে যাকাতের জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে যায় এবং সারাদিন ধাক্কা মোক্কা খেয়ে খালি হাতে ফিরে আসতে হয় বা পায়ের নীচে পিষ্ট হয়ে মারা যায়। তখন তাদের ঈদের খুশি কোথায় লুকিয়ে যায় সেটা কেউকি অনুভব করে ? করে না।
গত ঈদে বাবা আমরা দুই ভাই বোনকে চার সেট জামা কাপড় দিয়েছিল।এই বছর নতুন কাপড় ঝুটবে কিনা সন্দেহ। আমাদের এমন কোন বড় লোক আত্নীয় স্বজনও নেয় যে আমাদের একটা নতুন কাপড় কিনে দেবে। আমাদেরও যাকাতের উপর নির্ভর করে থাকতে হবে। প্রয়োজনে না খেয়ে রোজা রাখবো পুরাতন জামা গায়ে দিয়ে ঈদ উৎযাপন করবো। তবুও মানুষের ধাক্কা ধাক্কি খিল ঘুষি, লাঠিরবাড়ি অথবা কারো পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে মরতে যাব না। আমাদের এইসব করতে দেখলে আমাদের বাবার আত্না কষ্ট পাবে।
ইনশাল্লাহ আমি একদিন বড় হব। আমাদের হারানো সুখ আমি ফিরিয়ে আনবো। ভাবছি মাকে এখন শান্তনা দিতে গিয়ে কোন মিথ্যাটা বলবো। যাকাত আনতে গিয়ে যা যা ঘটেছে তা কি মাকে বলে দেব? চোখের সামনে এক বৃদ্ধ ও দুই শিশু ধাক্কাধাক্কি করতে গিয়ে মানুষের পায়ের নীচে পড়ে মারা গেল। কি নির্মম সে দৃশ্য। আমার মতে একটা নিয়ম করে ধনী ব্যক্তিরা যদি দরীদ্র এলাকায় পরিবার পিছু যাকাত পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্হা করতো তাহলে যাকাত আনতে গিয়ে এতো বিরম্বনায় পড়তে হতো না বা এতো লোকের প্রাণহানি ঘটতো না। গ্রাম প্রশাসন চাইলে এই উদ্যোগটা নিতে পারে।
Short Story Karuna Acherjee